ঢাকা, রবিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৫, ২০ আশ্বিন ১৪৩২

আমানতকারীদের রক্ষায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা উদ্যোগ: বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে দর্শক বিএসইসি

২০২৫ অক্টোবর ০৫ ০৮:৫৬:২৮
আমানতকারীদের রক্ষায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা উদ্যোগ: বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে দর্শক বিএসইসি

অর্থ বাণিজ্য প্রতিবেদক : বিগত সরকারের আমলে ব্যাংক খাতকে লুটপাটের কেন্দ্রস্থল বানিয়েছিল এস.আলম, সালমান এফ রহমান, নজরুল ইসলাম, পারভেজ তমালরা। এতে করে লাখ লাখ কোটি টাকার আমানত ঝুঁকিতে পড়েছে। এখন অনেক ব্যাংক গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতে পারছেন না। এই অবস্থায় আমানতকারীদের স্বার্থ উদ্ধারে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে এবং নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে ওইসব ব্যাংকের মালিক বা শেয়ারহোল্ডারদেরকে নিয়ে ভাবনা নেই কারো। যেখানে হাজার হাজার সাধারন বিনিয়োগকারীর মালিকানা রয়েছে। তারাও আমানতকারীদের মতো ক্ষতির মূখে। তাদের স্বার্থ রক্ষায় শেয়ারবাজারের রেগুলেটর হিসেবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) এগিয়ে আসা দায়িত্ব হলেও দর্শক ভূমিকায় রয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। এই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান দায়িত্ব বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা। কিন্তু তারা আবুল খায়ের হিরু, সালমান এফ রহমান, সাকিব আল হাসানসহ কয়েকজনকে আর্থিক শাস্তি দেওয়ার মধ্যে নিজেদের কর্মকান্ড আবদ্ধ করে রেখেছে। তারপরেও ১ টাকা আদায় করতে পারছে না। শুধুমাত্র কাগজে কলমে শাস্তির মধ্যে আটকে আছে।

এ বিষয়ে ডিএসইর এক পুরাতন ব্রোকার অর্থ বাণিজ্যকে বলেন, বিএসইসি শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে আইনের সঠিক প্রয়োগ করছে না। যাকে যেমন খুশি শাস্তি দিয়ে দিচ্ছে, সেটা কার্যকর করতে না পারলেও। এই অযৌক্তিক শাস্তি একসময় বিএসইসির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। কারন বিএসইসির শাস্তির বিষয়ে সবাই আদালতে যাবে। সেখানে এগুলো টিকবে না। তবে বিএসইসির আর্থিক খরচ ও সময় ব্যয় ঠিকই হবে।

অথচ বিনিয়োগকারীদের ব্যাংকগুলো থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা লুট হয়ে গেছে। এখন ওইসব ব্যাংকের আমানতকারীদের ন্যায় বিনিয়োগকারীরাও পথের ফকির। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থ ফেরতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এরমধ্যে ৫টি ব্যাংক একীভূত করা হবে। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ উদ্ধার এক্ষেত্রে উপেক্ষিত। এছাড়া বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ দেখা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ না। এর মূল দায়িত্ব বিএসইসির।

বিএসইসির মুখপাত্র মো. আবুল কালাম বলেন, যেকোনো তফসিলি ব্যাংকে জালিয়াতির জন্য স্পনসর, পরিচালক, উল্লেখযোগ্য শেয়ারহোল্ডার এবং শীর্ষ নির্বাহীদের দায়ী করা হবে। "কোনও কেলেঙ্কারির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কারণে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের বঞ্চিত করা উচিত নয়"।

এরইমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সংস্কারের মধ্যে শরিয়াহভিত্তিক ৫টি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। এই পাঁচ ব্যাংক হলো—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক। ইতোমধ্যে ব্যাংকগুলোতে অস্থায়ী প্রশাসনিক দল নিয়োগেরও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

সবগুলোই শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোতে হাজার হাজার বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ বা মালিকানা রয়েছে। আমানতকারীদের ন্যায় তারাও এরইমধ্যে ক্ষতির মধ্যে পড়েছে। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের ৫টি ব্যাংকের শেয়ার দরই অনেক তলানিতে।

নিম্নে একীভুত করার উদ্যোগ নেওয়ার ব্যাংকগুলোর বিস্তারিত তুলে ধরা হল-

ব্যাংকের নাম

পরিশোধিত মূলধন

সাধারন বিনিয়োগকারীদের মালিকানা

শেয়ার দর (টাকা)

ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক

১২০৮.১৪ কোটি টাকা

৯৪.১০%

২.৬০

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক

১১৪০.১৬ কোটি টাকা

৮৮.৩৮%

৪.৪০

গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক

৯৮৭.৪৪ কোটি টাকা

৮৪.৫৭%

১.৮০

ইউনিয়ন ব্যাংক

১০৬২.২৮ কোটি টাকা

৪৫.৫১%

১.৯০

এক্সিম ব্যাংক

১৪৪৭.৫৬ কোটি টাকা

৬৭.৫৬%

৪.০০

মোট

৫৮৪৫.৫৮ কোটি টাকা

.

গড়-২.৯৪

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ৫টি ব্যাংক এখন আনুষ্ঠানিকভাবে একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার অধীনে এসেছে, যা সম্পন্ন হতে দুই বছর সময় লাগতে পারে।

বিএসইসির মুখপাত্র বলেন, একীভূত হতে যাওয়া কিছু ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা রাষ্ট্রায়ত্ত বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের তুলনায় ভালো। তিনি আরও বলেন, এক্সিম ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা পর্যালোচনাকারী একজন আন্তর্জাতিক নিরীক্ষক ব্যাংকটির অনাদায়ী ঋণ (এনপিএল) ৩০ শতাংশ বলে জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, "এমন কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক আছে যাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক্সিম ব্যাংকের চেয়ে বেশি।" অন্যদিকে, পাঁচটি ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহক ভিত্তি ভালো।

একীভূত হওয়ার পর ব্যাংকের নাম কী হবে তা এখনো ঠিক করা হয়নি। তবে একীভূত হওয়ার পর এটাই হবে দেশের বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক। এর জন্য আনুমানিক ৩৫,২০০ কোটি টাকা মূলধনের প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে ২০,২০০ কোটি টাকা সরকার দেবে এবং বাকি ১৫,০০০ কোটি টাকা প্রাতিষ্ঠানিক তহবিল ও প্রাতিষ্ঠানিক আমানত রূপান্তরের মাধ্যমে আসবে।

আমানতকারীদের অগ্রাধিকার :

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আমানতের অর্থ ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তি আমানতকারীদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীরা নগদ অর্থের পরিবর্তে নবগঠিত ব্যাংকের শেয়ার পেতে পারেন।

প্রস্তাবিত পরিকল্পনা অনুযায়ী, ব্যক্তি আমানতকারীরা সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা পর্যন্ত বীমাকৃত অর্থ পাবেন— যেমনটা আমানত আইনের এর খসড়া সংশোধনীতে প্রস্তাব করা হয়েছে এবং বর্তমানে এটি চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর অধীনে ব্যাংকের লাইসেন্স বাতিলের দুই মাসের মধ্যেই এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে।

আর ২ লাখ টাকার বেশি আমানত ধাপে ধাপে ফেরত দেওয়া হবে, যদিও এ জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা চূড়ান্ত হয়নি। একীভূতকরণের মধ্যবর্তী সময়ে আমানতকারীরা ৪ শতাংশ হারে নির্দিষ্ট রিটার্ন পেতে পারেন, তবে সব বিদ্যমান আমানত স্কিম বাতিল হয়ে যাবে।

কোনো আমানতকারীর যদি পাঁচটি ব্যাংকেই একাধিক অ্যাকাউন্ট থাকে— তাহলে সেগুলো একটি হিসাব হিসেবে গণ্য হবে এবং মোট বীমার সীমা থাকবে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত। এর অতিরিক্ত অর্থ ধাপে ধাপে ফেরত দেওয়ার পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত হবে।

অন্যদিকে, ঋণগ্রহীতাদের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হবে না—কিস্তি নিয়মমতো পরিশোধ করতে হবে, আর খেলাপি হলে আগের নিয়মেই শাস্তি কার্যকর হবে।

তবে আমানতকারীদের জন্য পুরো ফেরত দেওয়ার পরিকল্পনা নির্ভর করছে আমানত সুরক্ষা আইনের এর খসড়া সংশোধনী চূড়ান্ত অনুমোদনের ওপর।

সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের কী হবে :

একীভূত হতে যাওয়া পাঁচটি ব্যাংকই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তালিকাভুক্ত, তবে একীভূত হওয়ার পর সেগুলো ডিলিস্ট করা হবে।

ব্যাংক কোম্পানি আইনে বলা আছে, অবসায়ন বা একীভূতকরণের ক্ষেত্রে সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা কোনো ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকারী নন। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে ভাবছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ নির্বাহী গণমাধ্যমকে জানান।

ডিলিস্টিং প্রক্রিয়া ও সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের সম্ভাব্য ক্ষতিপূরণ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈঠক করবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-এর সঙ্গে। ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ অনুযায়ী, এই পাঁচ ব্যাংকের লাইসেন্স বাতিল হবে, আর একীভূত নবগঠিত ব্যাংকের জন্য নতুন লাইসেন্স দেওয়া হবে।

তবে সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা ইতোমধ্যেই বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন—পাঁচ ব্যাংকের শেয়ারের দাম ১০ টাকা ফেইস ভ্যালুর বিপরীতে ৫ টাকারও নিচে নেমে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব সংস্কার করেছে :

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ব্যাংকগুলোয় তদারকি জোরদার করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি এত দিন নীতিমালায় যেসব ছাড় দেওয়া হয়েছিল, তা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করে। এছাড়া আগের সরকারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ অনুমোদন দিয়েছে। যার অধীন ব্যাংক একীভূত, অধিগ্রহণ ও অবসায়নের সুযোগ রাখা হয়েছে। এজন্য সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান ও সুবিধাভোগী যাচাইয়ে বিদেশি নিরীক্ষক দিয়ে নিরীক্ষা চলছে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংক খাতে যে ক্ষত হয়েছে, তা অপূরণীয়। বর্তমান সরকার সেটা থামাতে পেরেছে, এটা বড় অর্জন। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক যে পরিকল্পনাগুলো করছে, এটা বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে। ব্যাংকঋণের চাহিদা কম, ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। এদিকে মনোযোগ দিতে হবে।’

বাংলাদেশ যেসব ব্যাংকের পর্ষদ পূণ:গঠন করেছে :

প্রিমিয়ার ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল, এনআরবি, মেঘনা ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ইউসিবি ও এক্সিম ব্যাংক।

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে