ঢাকা, শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বিশেষ নিরীক্ষার বেরিয়ে আসবে সব অপকর্ম

আইপিও’র আগে ব্যবসায় নিয়মিত উত্থান হলেও এখন পতন

২০২৪ জুন ৩০ ০৯:৩২:০৫
আইপিও’র আগে ব্যবসায় নিয়মিত উত্থান হলেও এখন পতন

অর্থ বাণিজ্য প্রতিবেদক : শেয়ারবাজার থেকে টাকা নিয়ে ব্যবসায় সম্প্রসারণ করবে, বাড়বে আয় ও মুনাফা- এমন স্বপ্ন দেখিয়ে সাধারন বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৩০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে একমি পেস্টিসাইডস। প্রতারক নিরীক্ষকের হাত ধরে অতিরঞ্জিত আর্থিক হিসাব দেখিয়ে শেয়ারবাজারে আসা এ কোম্পানিটির আইপিওতে আসার আগে নিয়মিত আয় (পণ্য বিক্রি) ও মুনাফা বাড়ে। কিন্তু সেই কোম্পানির শেয়ারবাজারে আসার পরে কমতে কমতে এখন লোকসানে। মাত্র ২ বছরের ব্যবধানে এই অধ:পতন। তাই কোম্পানিটির বিগত ৫ বছরের আর্থিক হিসাবের প্রকৃত সত্য তথ্য বের করে আনতে বিশেষ নিরীক্ষা করা দরকার বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) এই পদক্ষেপে অপরাধী যেমন চিহ্নিত হবে, একইসঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াবে।

দীর্ঘদিনেও আইপিও ফান্ড ব্যবহার করতে না পারা একমি পেস্টিসাইডসকে শেয়ারবাজারে আনে ইস্যু ম্যানেজার শাহজালাল ইক্যুইটি। যার মালিকানায় রয়েছে বিএসইসি চেয়ারম্যান ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত ইউনুস গ্রুপের মোহাম্মদ ইউনুস। যার সহযোগিতায় কোম্পানিটি শেয়ারবাজারে আসতে পারে। যে ইউনুস কোম্পানিটিকে আনতে অনিয়ম করলেও তাতে সমস্যা হয়নি। কিন্তু একই অনিয়মের দায়ে বানকো ফাইন্যান্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও তার পরিবারকে ২৬ কোটি টাকা জরিমানা করে বিএসইসি।

প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে কোম্পানিটিকে শেয়ারবাজারে আনা হয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে প্লেসমেন্ট গ্যাংয়ের সদস্য ফরিদ এর নেতৃত্বের একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী। যার সঙ্গে কাজ করে ইউনুস, কাজী সাইফুর রহমান, ছাগল কান্ডের মতিউর রহমানসহ অন্যান্যরা। তারা একমি পেস্টিসাইডসে অনেক টাকার প্লেসমেন্ট বাণিজ্য করেছে।

এদিকে প্রতারক নিরীক্ষক সিরাজ খান বসাক অ্যান্ড কোং এর পার্টনার রমেন্দ্র নাথ বসাকের মাধ্যমে নিরীক্ষা করিয়ে শেয়ারবাজারে আনা হয় একমি পেস্টিসাইডসকে। যে প্রতারক নিরীক্ষক সিলভার কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলসের একই সময়ের দুই রকম অ্যাকাউন্টস নিরীক্ষা করেছে এবং সঠিক বলে সার্টিফিকেট দিয়েছে। যা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। এই জঘন্যতম কাজের জন্য তার নিরীক্ষা কাজের উপর ৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি)। আর সেই প্রতারক নিরীক্ষা করেছে একমি পেস্টিসাইডস।

এই প্রতারক নিরীক্ষক দিয়ে অতিরঞ্জিত আয় ও মুনাফা দেখিয়ে শেয়ারবাজারে আসে একমি পেস্টিসাইডস। যাতে এখন কোম্পানিটির অবস্থা বেহাল।

প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি শেষে কোম্পানিটির সবচেয়ে বেশি বড় পতন হয়েছে। ২০২১ সালের ১৪ নভেম্বর লেনদেন শুরু হওয়া এ কোম্পানিটির প্লেসমেন্ট শেয়ারে লক-ইন উঠে গেছে গত ১৪ নভেম্বর। যে কোম্পানিটির আইপিও পূর্ব ১০ কোটি ৫০ লাখ শেয়ারের মধ্যে ৪ কোটি ২৯ লাখ বা ৪০.৮৯ শতাংশ ছিল উদ্যোক্তা/পরিচালকদের। বাকি ৬ কোটি ২১ লাখ বা ৫৯.১১ শতাংশ ছিল প্লেসমেন্ট শেয়ার।

শেয়ারবাজারে আসার আগে প্রসপেক্টাসে কোম্পানিটির যে ৫ বছরের আর্থিক হিসাব প্রকাশ করা হয়, সেখানে নিয়মিত আয় ও মুনাফা বাড়ে বলে দেখানো হয়েছিল। দেখা গেছে, কোম্পানিটির ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ৯৪ কোটি ২৯ লাখ টাকার আয় টানা বেড়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে হয় ১৫৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে নিট মুনাফাও টানা বেড়ে ৮ কোটি ৩১ লাখ থেকে ১৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা হয়। কিন্তু কোম্পানিটির যখনই শেয়ারবাজার থেকে টাকা নেওয়া হয়ে যায়, তারপরে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে প্রকৃত ঘটনা।

শেয়ারবাজারে আসার পরে কোম্পানিটির ২০২১-২২ অর্থবছরে আয় কিছুটা বেড়ে হয় ১৫৯ কোটি ১১ লাখ টাকা। কিন্তু এবার আর মুনাফা আগের মতো হয়নি। শেয়ারবাজারে আসার আগে মুনাফা বাড়লেও তালিকাভুক্তির পরে কমে গেছে। ওই অর্থবছরে মুনাফা হয়েছে ১৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।

তবে এরপরের ২০২১-২২ অর্থবছরে হয়ে গেল সবদিক দিয়েই বড় পতন। কোম্পানিটির ১৫৯ কোটি ১১ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি নেমে আসল ১২০ কোটি ৪৬ লাখ টাকায়। এক্ষেত্রে কমল ৩৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকার বা ২৪ শতাংশ। তবে নিট মুনাফা কমে গেল আরও বেশি হারে। এক্ষেত্রে মুনাফা কমে ৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকার বা ৩১ শতাংশ।

এরপরের অর্থবছরে আরেক ধাপ এগিয়ে কোম্পানিটি লোকসানের মধ্য দিয়ে চলছে। চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই ২০২৩-মার্চ ২০২৪) কোম্পানিটির আগের অর্থবছরের ৯৫ কোটি ১৬ লাখ টাকার আয় নেমে এসেছে ৫৭ কোটি ৮২ লাখ টাকায়। তবে আগের অর্থবছরের ১১ কোটি ৫৮ লাখ টাকার মুনাফা চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে নেমে এসেছে ৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকা লোকসানে।

এ কোম্পানিটিকে শেয়ারবাজারে আনার ক্ষেত্রে অনিয়মে জড়িয়েছে ইস্যু ম্যানেজার শাহজালাল ইক্যুইটি। শেয়ারবাজারে কয়েক মাস আগে ইস্যু ব্যবস্থাপনা কোম্পানির সঙ্গে আত্মীয়দের শেয়ার ধারন থাকার দায়ে বানকো ফাইন্যান্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বড় অনিয়ম করেছে বলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছে প্রতিয়মান হয়। যে কারনে কমিশন তাকে শেয়ারবাজারে নিষিদ্ধ এবং তাকেসহ তার আত্মীয়দেরকে রেকর্ড ২৬ কোটি টাকা জরিমানা করে। যে ধরনের অনিয়ম শাহজালাল ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রেও হয়েছে একমি পেস্টিসাইডসকে আনার ক্ষেত্রে।

লাভেলো আইসক্রিম, সী পার্ল, বিবিএস কেবলস ও নাহি অ্যালুমিনিয়ামে বানকো ফাইন্যান্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কোন শেয়ার ধারণ না করেও ১০ কোটি টাকার আর্থিক ও ৫ বছরের নিষেধাজ্ঞার শাস্তির মুখে পড়তে হয়েছে। এছাড়া তার আত্মীয়-স্বজন ওইসব কোম্পানির প্লেসমেন্ট কেনার দায়ে তাদের ১৬ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

কিন্তু একমি পেস্টিসাইডসে একই ধরনের অনিয়ম করেছে শাহজালাল ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট। এই প্রতিষ্ঠানটিতে চেয়ারম্যান হিসেবে মাহফুজা ইউনুস ও প্রধান উপদেষ্টা মোহাম্মদ ইউনুস (সর্ম্পক্যে স্বামী-স্ত্রী) জড়িত থাকার পরেও তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোম্পানি একমি পেস্টিসাইডসের আইপিওকালীন শেয়ার ধারন করেছে। তবে এখনো শাস্তির আওতায় আসেনি।

একমি পেস্টিসাইডসে শাহজালাল ইক্যুইটির চেয়ারম্যান মাহফুজা ইউনুস ও তার স্বামী এবং প্রধান উপদেষ্টা মোহাম্মদ ইউনুসের পরিচালিত এবং তাদের মালিকানাধীন কোম্পানির ২৮ লাখ শেয়ার ধারন ছিল।

প্লেসমেন্টহোল্ডারদের স্বার্থে শেয়ারবাজারে আসা এ কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ২ বছরেও আইপিও ফান্ড ব্যবহার করতে পারেনি। প্রসপেক্টাসে ঘোষণা অনুযায়ি, কোম্পানিটির আইপিওতে উত্তোলন করা ৩০ কোটি টাকার সবটুকু ব্যবহারের সময়সীমা ছিল ২ বছর বা গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু কোম্পানিটির সর্বশেষ প্রকাশিত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত আইপিওর অব্যবহৃত ফান্ড রয়েছে ৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা বা ২৭ শতাংশ। এরসঙ্গে ব্যাংকে রাখায় সুদবাবদ পাওয়া আরও প্রায় ১ কোটি টাকা রয়েছে।

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে