ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর ২০২৪, ১৮ আশ্বিন ১৪৩১

ছাত্রলীগকে বেছে বেছে নিয়োগ দেয় কমিশন : বাতিলের  দাবি

২০২৪ আগস্ট ১৫ ০৮:৪৬:৩৬
ছাত্রলীগকে বেছে বেছে নিয়োগ দেয় কমিশন : বাতিলের  দাবি

অর্থ বাণিজ্য প্রতিবেদক : শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) ১২৭ জনের বিশাল নিয়োগ দেয় কমিশন। এরমধ্যে বেশিরভাগই বেঁছে বেঁছে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ছাত্রলীগকে। যাদের যোগ্যতাই ছিল ছাত্রলীগ করা। ওইসব ছাত্রলীগ কোটায় চাকরী পাওয়া কর্মীরা এখন বিএসইসির বোঝাঁ। যাদের নেই কোন মেধা, নেই কোন যোগ্যতা। তাই যে লক্ষ্যে বিএসইসিতে এই বিশাল নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, তা পূরণ হয়নি। ফলে ওই নিয়োগ বাতিল করে যোগ্যদের বাছাই করে পূণঃনিয়োগ করার দাবি বাজার সংশ্লিষ্টসহ বিএসইসিরই কর্মকর্তাদের।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, যেখানে যোগ্যতা ছাত্রলীগ, সেখানে বিএসইসিতে নিয়োগ পাওয়া সেইসব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থেকে ভালো কিছু আশা করা যায় না। ছাত্রলীগরা মেধাবি না। এরা শুরুই করে চাঁদাবাজি দিয়ে ক্যারিয়ার। যাদের লক্ষ্যই ছিল অন্যর টাকা মেরে খাওয়া। তাদের থেকে ভালো কিছু আশা করা বোঁকামি।

সংশ্লিষ্ট দাবি, বাংলাদেশের ছাত্রলীগরা যে কি পরিমাণ মেধাবি হতে পারে, তা কিন্তু সবাই জানে। এরা বছরের পর বছর ফেইল করে একই ক্লাসে থাকে। ৪ বছরের কোর্স মেয়াদ ১০ বছরেও শেষ করতে পারে না। এমন ছাত্রলীগকে নিয়োগের মাধ্যমে বিএসইসিকে দীর্ঘমেয়াদে ধংস করা হয়েছে। সিনিয়র কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যখন অবসরে যাবে, তখন বিএসইসি এক প্রকার পঙ্গু হয়ে যাবে। তাই এখনই ১২৭ জনের নিয়োগ বাতিল করে পূণ:নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।

১২৭ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিশালসংখ্যক নিয়োগে বিদ্যমান আইন, বিধিমালা ও সরকারি আদেশের তোয়াক্কা করেনি কমিশন। মহামারি করোনার কারণে সরকারি নির্দেশে যখন দেশব্যাপী লকডাউন চলছিল, তখন তড়িঘড়ি করে এই নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়। এক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশনাও আমলে নেয়নি কমিশন। বিএসইসির চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ এবং বিভিন্নভাবে শেয়ারবাজার থেকে সুবিধাভোগী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস ফ্যাকাল্টির দুজন অধ্যাপকের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয় এই নিয়োগ প্রক্রিয়া। এক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষার উত্তরপত্রও কমিশনে আসেনি।

পরবর্তী সময়ে এই দুজন শিক্ষককে শেয়ারবাজারসংক্রান্ত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর মধ্যে একজন হলেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বর্তমান পরিচালক ড. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এ রকম কিছু ঘটে থাকলে তা দুঃখজনক। কারণ বিএসইসির নিয়োগ ও পদোন্নতির জন্য আলাদা বিধিমালা আছে। তাদের অবশ্যই সেটা মানতে হবে। তার মতে, একটি প্রতিষ্ঠান কতটা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করবে, তা অনেকটা নির্ভর করছে অভ্যন্তরীণ সুশাসন ও শৃঙ্খলার ওপর। বিএসইসির মতো প্রতিষ্ঠানের জন্য এটি আরও প্রযোজ্য। তার মতে, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

বিএসইসিতে জনবল সংকটের অভিযোগ ছিল দীর্ঘদিনের। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত রিপোর্টেও জনবল বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়। পুরো শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য বিএসইসির জনবল ছিল ১৬৪ জন। তবে ২০১৯ সালের ১৬ অক্টোবর অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কমিশনের জনবল কাঠামোতে ২০৫টি নতুন পদের সৃষ্টির অনুমোদন দেয়। ফলে কমিশনের কাঠামোতে জনবলের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬৯। গত ৩ বছরে এই ২০৫টি পদে নিয়োগ দেয় কমিশন।

নতুন সাংগঠনিক কাঠামো অনুসারে ১০ ক্যাটাগরির পদের বিপরীতে ১২৭ জন জনবল নিয়োগের জন্য ২০২১ সালের ২৫ মার্চ পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় বিএসইসি। এর মধ্যে সহকারী পরিচালক (সাধারণ) পদে ৫৭ জন, সহকারী পরিচালক লিগ্যাল সার্ভিস ৪ জন, সহকারী পরিচালক (এমআইএস) ৪, জনসংযোগ কর্মকর্তা ২, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ১, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ২১, লাইব্রেরিয়ান ১, সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ৪, ক্যাশিয়ার ১, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ১, অভ্যর্থনাকারী ১, গাড়িচালক ৩ এবং অফিস সহায়ক পদে ২৭ জনের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়।

আগ্রহীদের ২০২১ সালের ১ থেকে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে আবেদন করতে বলা হয়। কিন্তু করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে ২০২১ সালের ১২ এপ্রিল প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ওই প্রজ্ঞাপনে ১৪ এপ্রিল থেকে দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করা হয়। এ সময় অতিজরুরি প্রয়োজন ছাড়া (ওষুধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয়, চিকিৎসাসেবা, মৃত্যুদেহ দাফন এবং করোনার টিকা গ্রহণ) কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়। এজন্য সাধারণ মানুষের বাইরে যাওয়া রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কড়া নির্দেশনা দিয়ে নামানো হয় রাস্তায়। এর ধারাবাহিকতায় ১৬ মে জারি করা আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারি করে ২৩ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয় লকডাউন। কিন্তু এই লকডাউনের মধ্যেই ২০২১ সালের ১৯ মে সহকারী পরিচালক পদে অনুষ্ঠিত হয় নিয়োগ পরীক্ষা। অর্থাৎ লকডাউনের ভেতরে সরকারের সব কার্যক্রম যখন বন্ধ ছিল, তখন পরীক্ষা নেয় বিএসইসি। এক্ষেত্রে লকডাউন সংক্রান্ত সরকারের নির্দেশনা লঙ্ঘন হয়েছে। এর মাধ্যমে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ সীমিত করা হয়।

এছাড়া পরীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস ফ্যাকাল্টিকে। পুরো বিষয়টির দায়িত্ব পান বিজনেস ফ্যাকাল্টির দুজন অধ্যাপক-ড. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ এবং ড. মোহাম্মদ তারেক। এই নিয়োগের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, পরীক্ষা গ্রহণ এবং উত্তরপত্র মূল্যায়নসহ যাবতীয় কাজ এই দুজনই করেছেন। নিয়ম অনুসারে লিখিত পরীক্ষায় যারা অংশ নিয়েছেন, তাদের উত্তরপত্র কমিশনে আসার কথা। কিন্তু পরীক্ষার কোনো উত্তরপত্র কমিশনে পাঠানো হয়নি। শুধু উত্তীর্ণদের একটি তালিকা কমিশনে পাঠানো হয়। এই তালিকার ভিত্তিতে মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে ১২৭ জনকে চাকরির জন্য চূড়ান্ত করা হয়।

মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণের দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদাদলের প্রভাবশালী শিক্ষক প্রফেসর ড. মাহমুদ ওসমান ইমামকে। নতুন নিয়োগ পাওয়া ১২৭ জনের এই সংখ্যা ছিল ওই সময়ে বিএসইসিতে কর্মরত মোট জনবলের ৭৮ শতাংশের সমান। এ বিশাল নিয়োগ ছাত্রলীগদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হলেও, তা নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ কথা বলেনি এতোদিন। এরপরও আরও কয়েক দফায় জনবল নিয়োগ দেয় কমিশন।

অন্যদিকে লিখিত পরীক্ষার দায়িত্ব পাওয়া এই দুজন শিক্ষক ড. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ও ড. মোহাম্মদ তারেক বিএসইসির বর্তমান চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের অনুগত হিসাবে ব্যাপক পরিচিত। কমিশনে যোগদানের আগে শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম নিজেও বিজনেস ফ্যাকাল্টির ডিন ছিলেন। ফলে এখানে কনফ্লিক্ট অব ইনটেরেস্ট্রের (স্বার্থের দ্বন্দ্ব) বিষয় জড়িত।

নিয়োগ চূড়ান্ত হওয়ার পর ড. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদকে ডিএসইর পরিচালক এবং ড. মোহাম্মদ তারেককে শেয়ারবাজারের আরেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনস্টিটিউটের (বিআইসিএম) নির্বাহী প্রেসিডেন্ট করা হয়। বর্তমানে ড. তারেক বিআইসিএমের ওই পদে কাজ করছেন। এছাড়া তাকে সেন্ট্রাল কাউন্টার পার্টি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিসিবিএল) এবং বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট স্টাবিলাইজেশন ফান্ডের (সিএমএসএফ) পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

বিএসইসির প্রশাসনিক ব্যবস্থা, পদোন্নতি, পদায়ন ও দায়িত্ব বণ্টন প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন থেকে সুশৃঙ্খল এবং অন্য প্রতিষ্ঠানের জন্য অনুকরণীয় ছিল। কিন্তু শিবলী কমিশন চরম স্বেচ্ছাচারিতা করে।

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে