ঢাকা, বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২

তদন্ত কমিটির মেয়াদ শেষে পূর্বের তারিখ দেখিয়ে রিপোর্ট জমা

২০২৫ এপ্রিল ২৮ ১৪:১৫:৪৭
তদন্ত কমিটির মেয়াদ শেষে পূর্বের তারিখ দেখিয়ে রিপোর্ট জমা

অর্থ বাণিজ্য প্রতিবেদক : দেশের শেয়ারবাজারে বিগত সময়ের অনিয়ম, দুর্নীতি ও কারসাজির ঘটনা খতিয়ে দেখতে গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের একটি অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। যে কমিটির মেয়াদ কয়েক দফায় বাড়ানোর পরে গত ৩১ মার্চ শেষ হয়েছে। যা বাড়ানো হবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিএসইসি। তবে এরমধ্যে কমিটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে ব্যর্থ হয়। এ কারনে ওই কমিটি মেয়াদ শেষে ৩১ মার্চের পূর্বের তারিখ দেখিয়ে দুটি কোম্পানির রিপোর্ট জমা দিয়েছে। যা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে প্রশ্ন উঠেছে।

কমিটিকে ৬০ দিবস সময় দিয়ে বেক্সিমকো গ্রীন-সুকুক আল ইসতিসনা, IFIC Guaranteed Sreepur Township Green Zero Coupon Bond, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ পিএলসি (সিএসই) এর স্ট্যাটেজিক পার্টনার, বেস্ট হোল্ডিংস, আল-আমিন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস লিমিটেড, ফরচুন সুজ, রিং শাইন টেক্সটাইল, একমি পেস্টিসাইডস, কোয়েস্ট বিডিসি লিমিটেড (পূর্বে পদ্মা প্রিন্টার্স অ্যান্ড কালারস লিমিটেড), কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজ ও এমারেল্ড ওয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ বিষয়ে তদন্ত করতে বলা হয়।

এজন্য সিকিউরিটিজ অ্যান্ড কমিশন অধ্যাদেশ ২১ ধারা এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন ১৭ ধারা বিএসইসি জিয়া ইউ আহমেদ এর নেতৃত্বে “অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি” গঠন করে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে ড. জিয়া ইউ আহমেদকে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- ইয়াওয়ার সাইদ, মো: শফিকুর রহমান, ব্যারিস্টার মো: জিশান হায়দার ও বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মো: আনোয়ারুল ইসলাম।

তবে ওই কমিটি ৬০ দিবসে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে ব্যর্থ হয়। এ কারনে কয়েক দফায় সময় বাড়ানো হয়। তবে সর্বশেষ ৩১ মার্চ কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আর মেয়াদ না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কমিশন। তবে ওই সময়ের মধ্যে তদন্ত কমিটি ৮টি কোম্পানির তদন্ত রিপোর্ট দিতে সফল হয়েছিল। বাকি থাকে আরও ৪টি কোম্পানির তদন্ত রিপোর্ট।

এরপরে গত সপ্তাহের কমিশন সভায় কমিটিকে ১ মাস সময় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। কিন্তু কমিশনের এই সময় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই এবং মেয়াদ শেষে বা ৩১ মার্চের পরে ১টি কোম্পানির তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে তদন্ত কমিটি। এছাড়া মেয়াদ বাড়ানোর পরে ১টি রিপোর্ট জমা দিয়েছে। যেটা তদন্ত কমিটির প্রধান বিদেশ যাওয়ার আগে পূর্বের তারিখ উল্লেখ করে সাক্ষর করে গেছেন। অর্থাৎ ২টি রিপোর্টই ৩১ মার্চের পূর্বের তারিখ উল্লেখ করে জমা দিয়েছে।

বিতর্ক এড়ানোর জন্য এই মেয়াদ বাড়িয়ে আরেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে বিএসইসি। মেয়াদ শেষে পূর্বের তারিখ দেখিয়ে রিপোর্ট জমা দেওয়ায় বিতর্ক তৈরী হবে, এমনটি দাবি করে তদন্ত কমিটি সময় বাড়িয়ে নেয়। তবে সেময় বাড়ানোর আগেই পূর্বের তারিখ দেখিয়ে ২টি রিপোর্ট জমা দিয়েছে।

এ বিষয়ে ডিএসইর সিনিয়র এক ব্রোকার অর্থ বাণিজ্যকে বলেন, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে তদন্ত কমিটির মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। অর্থাৎ ওই তদন্ত কমিটি মেয়াদ শেষে অকার্যকর হয়ে গেছে। ওইটার আর কোন অস্তিত্ব থাকে না। আপনি চাইলেই মেয়াদ শেষ হওয়ার কিছুদিন পর গিয়ে মেয়াদ বাড়ানোর ঘোষনা দিলেন, আর সেটা সঠিক হয়ে যাবে-এমন না।

এ বিষয়ে বিএসইসির পরিচালক ও মূখপাত্র আবুল কালাম অর্থ বাণিজ্যকে বলেন, তদন্ত কমিটির মেয়াদ গত ৩১ মার্চ শেষ হয়েছে। এরপরে গত সপ্তাহের কমিশন সভায় আরেক মাস সময় বাড়ানো হয়েছে। ওই কমিটি গত ৩১ মার্চের মধ্যে ৮টি কোম্পানির বিসয়ে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে। আর চলতি মাসে দিয়েছে ২টি।

এই ২ রিপোর্ট পূর্বের তারিখ উল্লেখ করে এবং ৩১ মার্চের পরে মেয়াদ বাড়ানোর আগে জমা দেওয়া হয়েছে কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তদন্ত কমিটি আগেই মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছিল। পরে কমিশন মেয়াদ বাড়িয়েছে। সে হিসেবে চলতি মাসের যখনই রিপোর্ট জমা দেওয়া হোক না কেনো, তা কমপ্লাইড বা সঠিক আছে। এসময় তিনি জানান, সোনালি পেপার ও এমারেল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজের তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়া এখনো বাকি রয়েছে। তারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দিয়ে দেবে।

সব রিপোর্ট জমা দিতে না পারলেও কমিটির মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। তবে কমিটি ৩১ মার্চের পরে বাকি থাকা কোম্পানিগুলোর তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে শুরু করে। যেগুলোতে ৩১ মার্চের পূর্বের তারিখ উল্লেখ করে দেওয়া হচ্ছে।

এই তদন্ত কমিটি নিয়ে বিভিন্ন মহলের ন্যায় প্রশ্ন তুলেছে বিএসইসিরই কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। যারা কমিটির বিতর্কিত সদস্য ও অবৈধভাবে বেশি করে সম্মানি নেওয়ার বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে। যে বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য তদন্ত কমিটির সদস্যরা বিএসইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাঁপও দেয়।

গত ০৬ মার্চ বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে সদস্য সচিব ও অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ মিরাজ উস সুন্নাহ সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তদন্ত কমিটির অনিয়মের বিষয়ে সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন।

এতে অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে দাবি করা হয়, বিতর্কিত লোক, যাদের বিরুদ্ধে কমিশন পূর্বে বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং এখনো Enforcement প্রক্রিয়া চলমান, তাদেরকে দিয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে পুঁজিবাজার তদন্তের নামে কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এছাড়া বিধিতে/সরকারি নিয়মানুযায়ী কমিটির সদস্যদের প্রতি সভার সম্মানি-ভাতা বাবদ ৩০০০-৫০০০ টাকা প্রদানের উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে প্রতিমাসে মন্ত্রনালয়ের অনুমোদন ব্যতিরেকে কমিটির বহিরাগত প্রতি সদস্যকে ২ লক্ষ টাকা প্রদান করছে মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশন। যা সম্পূর্ণরুপে পুঁজিবাজার স্বার্থ বিরোধী এবং বে-আইনী।

এর আগে গত ৫ মার্চ সিকিউরিটিজ কমিশন ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনেও তদন্ত কমিটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেন বিএসইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে নির্বাহী পরিচালক মাহবুবুল আলম।

সংবাদ সম্মেলনে বিএসইসির মাহবুবুল আলম বলেন, বিএসইসির এই তদন্ত কমিটি বিতর্কিত। এই বিতর্কিত বলার পেছনে কারন হিসেবে রয়েছে, তদন্ত কমিটির ২ জন বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের। তারা বিএসইসি থেকে লাইসেন্স প্রাপ্ত হিসেবে দীর্ঘদিন ধরেই কমিশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। একারনে এখানে একটা স্বার্থের সংঘাত (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) থেকে যায়।

এছাড়া তাদের তদন্ত রিপোর্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলেন মাহবুবুল আলম। তিনি বলেন, তদন্ত রিপোর্টে অনেকটা বিএসইসির কর্মকর্তারা ‘একটিভ ভয়েসের পরিবর্তে প্যাসিভ ভয়েসে’ কেনো লিখেছে, এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। যেটাকে অসদাচরন এবং দায়িত্বে চরম অবহেলা বলা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্টে এই জাতীয় সমস্যায় তুলে ধরা হয়েছে।

তিনি বলেন, এই তদন্ত কমিটি অ্যাক্ট অ্যান্ড অর্ডিনেন্সের অধীনে গঠিত হয়েছে। এই অধীনে গঠিত হওয়া মানে সুনির্দিষ্ট কোন অনিয়ম পেলে, তা তুলে ধরবে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ কাজটি করে আসছি। কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে দোষী সাব্যস্ত করা এই তদন্ত কমিটির কাজ না। অ্যাক্ট অ্যান্ড অর্ডিনেন্সের অধীনে তদন্ত করে চাকরি বিধিমালায় শোকজ করা যায় না।

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে