ঢাকা, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

শিবলী কমিশনের সময়ে পঁচা কোম্পানিতে কারসাঁজি পেয়েছে ভিন্ন মাত্রা

২০২৪ জানুয়ারি ২১ ০৯:৩২:৫৫
শিবলী কমিশনের সময়ে পঁচা কোম্পানিতে কারসাঁজি পেয়েছে ভিন্ন মাত্রা

সারা বিশ্বের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ প্রেমিদের বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে আসার আহবান জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগি অধ্যাপক আল-আমিন লিখেছেন, এখানে নো ডিভিডেন্ড দেয়ার পর কোম্পানির শেয়ারের দাম ৭ গুন বেড়ে যায়। দেশের সকল ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়াতে এসব খবর প্রকাশের পরও যখন কেউ এসবের দর বৃদ্ধি দাবায় রাখতে পারছে না, সেটা দেখে মাত্র ৩৮ দিনে এরচেয়েও বাজে কোম্পানি ৯.১০ টাকা থেকে ২৯.৭০ হয়েছে। যেগুলোর লক্ষ লক্ষ ক্রেতা আছে, কিন্তু কোন বিক্রেতা নাই। তবে মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানিতে ক্রেতা নেই।

তিনি লিখেন, বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে একটি শেয়ারের দর খুব দ্রুত কতগুন হতে পারে, সেই ম্যাজিক দেখার জন্য খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। কারন এই দেশের শেয়ারবাজারে সোনা ফলে বন্ধ কোম্পানিতে। এসব কোম্পানি গুনগত মানে অনন্য, লম্বা সময় ধরে উৎপাদন বন্ধ ও ব্যাংক হিসাব জব্দ করা। যেদেশে ভাল শেয়ার দিনের পর দিন ক্রেতা শূন্য থাকে, সেদেশে উৎপাদন বন্ধ কোম্পানি অল্প সময়ে ৭/৮ গুন বেড়ে যায়, এমন বাজার এই দুনিয়াতে আর কোথাও নাই।

গত কয়েক বছর ধরে শেয়ারবাজারে এমন দৃশ্য হরহামেশ। বিশেষ করে বললে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর এমন দৃশ্য বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে ভিন্ন মাত্রা পায়। যেখানে যতসব পঁচা শেয়ার নিয়ে খেলাধূলা করা হয়। এতে বিভিন্নভাবে সহযোগিতার হাত থাকে কমিশনের। সেটা পর্ষদ পূণ:গঠন, মালিকানায় পরিবর্তন, একীভূতকরন ইত্যাদি ফরমেটে।

তবে শিবলী কমিশনের দায়িত্ব গ্রহণের শুরুতে বন্ধ কোম্পানিকে পূণ:রীজ্জিবীত করার প্রয়াশকে খুব ভালোভাবে গ্রহণ করেছিল বিনিয়োগকারীরা। তারা একের পর এক কোম্পানির পর্ষদ পূণ:গঠন করে। এতে ওইসব কোম্পানির উৎপাদনে ফেরার মাধ্যমে ভালো কিছুর আশা করেছিল বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু সেটা আর হয়নি।

এছাড়া ওটিসিতে স্থানান্তরের মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া ও অস্তিত্বহীন কোম্পানিকেও শিবলী কমিশন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু তার আগেই শিবলী কমিশনের কাছের মানুষজন সেসব কোম্পানির শেয়ার নিয়ে প্রথম ধাপে কারসাজি করে ফেলে। শেয়ার নিজেদের কাছে নিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরী করে ফেলে। যেগুলো এসএমই বা মূল মার্কেটে ফেরা মাত্রই শুরু করে গেম।

শেয়ারবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ অর্থ বাণিজ্যকে বলেন, এসব বলে এখন আর কোনো লাভ নেই। আমাদের শেয়ারবাজার কোনো স্বাভাবিক বাজার না। স্কয়ার ফার্মা গত বছরও একই পরিমাণ লভ্যাংশ দিয়েছিল। কোম্পানি আরও বড় হচ্ছে, এর সম্ভাবনা ব্যাপক। এর শেয়ার যারা কিনেছেন তারা প্রকৃত বিনিয়োগকারী। কিন্তু ইমাম বাটনের শেয়ার যারা কিনেছেন, তারা তো তা নন।

তিনি বলেন, আমাদের মার্কেট খুবই অদ্ভুত। এখানে একাধিক সিন্ডিকেট কাজ করে। তাদের কাজই হলো যেসব কোম্পানির শেয়ার সংখ্যা কম, সেগুলো নিয়ে খেলাধুলা করা। কোম্পানির কী চিত্র, তা এখানে গুরুত্বপূর্ণ না।

আরও পড়ুন......

সাড়ে ৩ বছরেই ভেঙ্গে পড়েছে শিবলী কমিশনের আইপিওর কোম্পানিগুলো

সম্প্রতি কারসাঁজির পরিকল্পনা ও মাঠ তৈরী করে রাখা আল-আমিন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ ও রাঙ্গামাটি ফুড প্রোডাক্টস এসএমইতে লেনদেন শুরু করতে যাচ্ছিল। যার নেতৃত্বে ছিল গেম্বলার বা কাঁরসাজিকর আবুল খায়ের হিরুর নেতৃত্বে একটি চক্র। যারা এসএমইতে কোম্পানি দুটির কৃত্রিম শেয়ার সংকটের মাধ্যমে আকাশচুম্বি করার পরিকল্পনা করে। তবে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ সেই পরিকল্পনা আটকে দিয়েছে। মন্দা ব্যবসার কোম্পানি দুটিকে এসএমইতে স্থানান্তর আবেদন বাতিল করে দিয়েছে ডিএসই কর্তৃপক্ষ।

তবে বিএসইসির চাপের কাছে ডিএসই সেটা কতদিন ধরে রাখতে পারবে, তা নিয়ে আছে সন্দেহ। কারন ডিএসই পৃথক প্রতিষ্ঠান এবং প্রাইমারী রেগুলেটর হলেও বিএসইসি স্টক এক্সচেঞ্জটিকে সব নির্দেশ মানতে বাধ্য মনে করে। সেটা অন্যায্য হলেও। যা হয়েও আসছে।

ডিএসই কোম্পানি দুটির এসএমইতে স্থানান্তরের আবেদনের আলোকে সরেজমিনে কারখানা ও প্রধান কার্যালয় পরিদর্শন করে। এছাড়া তারা প্রয়োজনীয় সকল তথ্য ও প্রমাণাদি যাচাই করে। এতে করে কোম্পানি দুটির বিভিন্ন সমস্যা উঠে আসে এবং এসএমইতে স্থানান্তরের যোগ্যতা নেই বলে প্রতিয়মান হয়।

তারপরেও ডিএসই কোম্পানি দুটির এসএমইতে তালিকাভুক্ত বাতিল করার জেরে কমিশনার, নির্বাহী পরিচালকসহ ২৫ কর্মকর্তার দায়িত্ব পুনর্বণ্টন করেছে বিএসইসি। যার সঙ্গে আল-আমিন কেমিক্যাল ও রাঙ্গামাটি ফুড নামে দুই কোম্পানির শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির আবেদন নাকচের সম্পর্ক রয়েছে।

যাদের কর্ম পুনর্বণ্টন করা হয়েছে, তাদের মধ্যে বিএসইসির কমিশনার আবদুল হালিম ও নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল ইসলামের বিষয়টি বেশি আলোচিত হচ্ছে। আনোয়ারুল ইসলামকে মার্কেট অ্যান্ড ইন্টারমিডিয়েটরিজ বিভাগের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ডিরাইভেটিবস ও গবেষণা বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আবদুল হালিমের দায়িত্বের মধ্যেও ওই বিভাগ ছিল। মার্কেট অ্যান্ড ইন্টারমেডিয়েটরিজ বিভাগই স্টক এক্সচেঞ্জের কর্মকাণ্ড তদারক ও নিয়ন্ত্রণ করে। অনেকের ধারণা, ওই দুই কর্মকর্তার থেকে সম্মতি পেয়ে তালিকাভুক্তির আবেদন নাকচ করেছে ডিএসই। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, কোম্পানি দুটির তালিকাভুক্তির আবেদন নাকচ করার আগে বিএসইসির কাছে ডিএসই মতামত চেয়েছিল। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ দেয় বিএসইসির মার্কেট অ্যান্ড ইন্টারমিডিয়েটরিজ বিভাগ বিভাগ।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেয়ারবাজারে বন্ধ কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচায় একটি ‘ব্রোকার গ্রুপ বা দালাল চক্র’ গড়ে উঠেছে। এমনই এক দালাল চক্রের মাধ্যমে বন্ধ কোম্পানি রাঙামাটি ফুড প্রোডাক্টসের সঙ্গে যুক্ত হয় এক্সপো গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রথমে তারা কোম্পানিটির প্রকৃত উদ্যোক্তাদের শেয়ারের পুরোটা (১০ লাখ শেয়ার) কিনে নেয় প্রায় এক কোটি টাকায়। সঙ্গে ব্যাংকের দায়দেনার ভারও নেয়। এরপর মালিকানা হাতবদল হয়ে চলে আসে এক্সপো গ্রুপের কাছে। এরপরই ঘটে রাঙামাটি ফুডের শেয়ার নিয়ে কারসাজি ও নানা অনিয়ম।

ডিএসইর তদন্তে রাঙামাটি ফুড প্রোডাক্টস নিয়ে বড় ধরনের যেসব অনিয়ম পাওয়া যায়, তার মধ্যে রয়েছে টাকা ছাড়া নতুন শেয়ার ইস্যু, ভুয়া কাজ দেখিয়ে অর্থ খরচ, যন্ত্রপাতি কেনার ভুয়া বিল তৈরি, জনবল ও পরামর্শককে ভুয়া বেতন প্রদানসহ আর্থিক নানা অনিয়ম।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মালিকানা হাতবদলের পর রাঙামাটি ফুডের নতুন ৪ কোটি শেয়ার (১০ টাকা অভিহিত মূল্যের হিসাবে যার দাম ৪০ কোটি টাকা) ইস্যু করা হয় গুটিকয়েক সুবিধাভোগীর মধ্যে। এর মধ্যে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ শেয়ার নেয় এক্সপো গ্রুপের মালিক ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ৫ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। বাকি ২ কোটি ৮০ লাখ শেয়ার প্রায় ২০০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা হয়। ২০২১ সাল থেকে চলতি বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে প্লেসমেন্টের মাধ্যমে কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রির এ ঘটনা ঘটে। তাতে মাত্র ৩ কোটি পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটির মূলধন বেড়ে হয় ৪৩ কোটি টাকা। নতুন শেয়ার ইস্যুর পর কোম্পানিটিকে ওটিসি থেকে এসএমই বোর্ডে (ক্ষুদ্র ও মাঝারি কোম্পানির শেয়ার লেনদেনের আলাদা প্ল্যাটফর্ম) স্থানান্তরের জন্য কারখানাও চালু করা হয়।

একইভাবে এসএমইতে আসার আগে আল-আমিন কেমিক্যালের শেয়ার নিয়েও কারসাজির পুরো পরিকল্পনা হয়ে গেছে। এ কোম্পানিটিতে গেম্বলার হিরুর পার্টনার ক্রিকটার সাকিব আল হাসানের দুইটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানসহ আরো পাঁচ জন ব্যক্তিকে ৪৮.১৭৫ শতাংশ শেয়ার অধিগ্রহণ করার অনুমতি দেয় বিএসইসি। এর মধ্যে সাকিবের প্রতিষ্ঠান দুটির মধ্যে মোনার্ক মার্ট (জাভেদ এ মতিন প্রতিনিধিত্বকারী) ২.৪০ শতাংশ এবং মোনার্ক এক্সপ্রেস ৪.৮০ শতাংশ। এ ছাড়া আমিনুল ইসলাম সিকদার এবং মো. খায়রুল বাশার (ইশাল কমিউনিকেশনের প্রতিনিধিত্বকারী) ১৪.৪ শতাংশ, এএফএম রফিকুজ্জামান ১০ শতাংশ, মাশুক আলম ৬ শতাংশ, মো. হুমায়ুন কবির (লাভা ইলেকট্রোডস ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিনিধিত্বকারী) ২.৪০ শতাংশ এবং মুন্সী শফিউদ্দিন ৮.১৮ শতাংশ কেনার অনুমতি দেয়।

এর আগে ২০২১ সালের ১৩ জুন ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেট থেকে মূল মার্কেটে ফিরেই বাংলাদেশ মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং, পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, তমিজউদ্দিন টেক্সটাইল মিলস, মুন্নু ফেব্রিকসের শেয়ার দর লাগামহীন বাড়ে। ব্যবসায় বড় পতনের পরেও মূল মার্কেটে ফেরার মাত্র ৩ মাসের ব্যবধানে কোম্পানিগুলোর গড় শেয়ার দর বাড়ে ৮০০ শতাংশ করে। যার পেছনে কোন কারণ খুজেঁ পায়নি ডিএসই কর্তৃপক্ষ।

এছাড়া বর্তমান কমিশনের অধীনে ওটিসির অনেক কোম্পানির কাগুজে শেয়ার নিয়ে খেলাধূলা চলছে। যেসব কোম্পানির অস্তিত্ব নেই। এছাড়া শেয়ার কাগুজে রয়েছে। তারপরেও শিবলী কমিশন সেগুলোকে মূল মার্কেটে ফিরিয়ে আনবে এমন তথ্যে কাগুজে শেয়ার নিয়েই হাহাকার চলছে। এক্ষেত্রে ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েজ, বেঙ্গল বিস্কুট, গাছিহাটা ফিসারিজ ও ম্যাক পেপার অন্যতম।

এতো গেল বন্ধ ও দূর্বল কোম্পানিকে ওটিসি থেকে এনে কারসাজির মাধ্যম। এছাড়া মূল মার্কেটের উৎপাদন বন্ধ থাকা অসংখ্য কোম্পানি নিয়ে হচ্ছে খেলাধূলা। এ তালিকায় শ্যামপুর সুগার মিলস, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ, সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস, এমারেল্ড অয়েল, জিকিউ বলপেন, ফু-ওয়াং ফুড, আফতাব অটো, সমতা লেদার, বীচ হ্যাচারি, অলিম্পিক এক্সেসরিজ ইত্যাদি কোম্পানি।

এরমধ্যে খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগের গত ৯ মাসে দর বেড়েছে ১২০৩ শতাংশ। এছাড়া আর.এন স্পিনিংয়ের ২৩৭ শতাংশ, খুলনা প্রিন্টিংয়ের ১৯৩ শতাংশ, দেশবন্ধু পলিমারের ১৭৭ শতাংশ, ফার কেমিক্যালের ১৬৬ শতাংশ, শ্যামপুর সুগারের ১৫৭ শতাংশ ও ইমাম বাটনের ১০০ শতাংশ দর বেড়েছে।

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে