ঢাকা, শনিবার, ১৬ আগস্ট ২০২৫, ১ ভাদ্র ১৪৩২

জাল দলিলসহ বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে অবৈধভাবে শেয়ারবাজারে : দোষীদের শাস্তির দাবি

২০২৪ আগস্ট ২৬ ১২:১৩:০০
জাল দলিলসহ বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে অবৈধভাবে শেয়ারবাজারে : দোষীদের শাস্তির দাবি

অর্থ বাণিজ্য প্রতিবেদক : শেয়ারবাজারে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয় প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) আসা কোম্পানিগুলো নিয়ে। গত ১ দশক ধরে এই সমালোচনা চলছে। এর মূল কারন হিসেবে রয়েছে অতিরঞ্জিত আর্থিক হিসাব দেখিয়ে দূর্বল, মানহীন ও অযোগ্য কোম্পানির তালিকাভুক্তি। এমনকি বিএসইসিরই তদন্তে উঠে আসা জাল দলিলের কোম্পানিও অবৈধ লবিংয়ের মাধ্যমে শেয়ারবাজারে এসেছে। বাজারে ওষুধ পাওয়া যায় না এশিয়াটিক ফার্মাসিউটিক্যালসের মতো মানহীন সেই কোম্পানির এখন শেয়ারবাজারে লেনদেনও হচ্ছে। যে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ কোম্পানিটিকে শেয়ারবাজারে আনতে সর্বোচ্চ ছাড় দিতে রাজি ছিল।

তবে খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশনকে নিয়ে আস্থা তৈরী করতে চায় বিনিয়োগকারীরা। এশিয়াটিকের মতো ভূয়া তথ্য দিয়ে আসা সব কোম্পানি ও এরসঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে শাস্তির আওতায় আনবে বলে বিশ্বাস করতে চায় তারা। যদিও রাশেদ মাকসুদ এরইমধ্যে বিগত সময়ের অনিয়ম খুঁজে বিএসইসির ভিতরে এবং বাহিরে যারা জড়িত, তাদের সবাইকে শাস্তির আওতায় আনবেন বলে রবিবার (২৫ আগস্ট) এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন। যার বাস্তবায়ন চায় বিনিয়োগকারীরা। কারন এর আগেও যারাই বিএসইসির চেয়ারে বসেছেন, তারাও দোষীদের শাস্তি দেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু নিজেরাই অনিয়মে জড়িয়েছিলেন।

বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করে নিয়ে যাওয়া এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের স্থায়ী সম্পদ নিয়ে বিভিন্ন অপকর্ম খুঁজে পায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। এছাড়া ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলও (এফআরসি) খুঁজে পায় নানা অপকর্ম। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করতে এতোটাই অনিয়ম করেছে যে, যা কোম্পানিটির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) বাতিলের জন্য যথেষ্ট ছিল। এই অবস্থায় আইপিও বাতিল ঠেকাতে অবৈধ পথে নামে এশিয়াটিক কর্তৃপক্ষ। এজন্য বিএসইসিকে পক্ষে আনতে লবিং করে। এজন্য যত টাকা প্রয়োজন, তাও খরচ করতে রাজি ছিল এশিয়াটিক কর্তৃপক্ষ।

সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ ১৯৬৯ এর ২সিসি এর অধীনে ১১ নং শর্তে বলা হয়েছে, আইপিও আবেদনে যেকোন ধরনের মিথ্যা তথ্য প্রদান আইপিও বাতিল হওয়ার জন্য দায়বদ্ধ থাকবে। এছাড়া আবেদনের ২৫% অর্থ বা শেয়ার ক্ষতিপূরন দেবে। যা বিএসইসির হিসাবে জমা করা হবে। এছাড়াও আইন দ্ধারা অন্যান্য শাস্তি প্রদান করা হতে পারে।

এশিয়াটিক ল্যাবের অসংখ্য অনিয়ম ও মিথ্যা তথ্যের কারনে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ ১৯৬৯ এর ২সিসি এর অধীনে ১১ নং শর্ত অনুযায়ি আইপিও বাতিলের যোগ্য ছিল। এছাড়া সম্প্রতি বিএসইসি এমন অনিয়মের কারনে কিছু কোম্পানির আইপিও আবেদন বাতিল করেছিল। কিন্তু এশিয়াটিকের মতো বিতর্কিত কোম্পানিটিকে অজানা কারনে তালিকাভুক্ত করে নেয়।

এফআরসির তদন্তে এশিয়াটিক ফার্মার সম্পদ অতিমূল্যায়িতসহ আর্থিক হিসাবে নানা অনিয়ম পাওয়া যায়। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ সম্পদ বাড়িয়ে দেখানোর জন্য মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। এছাড়া কোম্পানির চলতি সম্পদ, আয়, মুনাফা ও শেয়ার মানি ডিপোজিট নিয়ে অসঙ্গতি পায়। যা বিএসইসিকে অবহিত করে।

আরও পড়ুন....

আইপিওতে বিএসইসি কর্মকর্তাদের বেনামে শেয়ার ঘুষ

জানা গেছে, এশিয়াটিক কর্তৃপক্ষ বুক বিল্ডিংয়ে উচ্চ দর পেতে এবং বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে ভূয়া সম্পত্তি দেখায়। যা কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের মাধ্যমে নিজেদের শেয়ারধারনও বাড়িয়ে দেয়।

এশিয়াটিক কর্তৃপক্ষ প্রসপেক্টাসে কোটি কোটি টাকার ভূয়া সম্পত্তি দেখিয়েছে। বেশি দামে রেজিস্ট্রি, পূণ:মূল্যায়নের মাধ্যমে অতিরঞ্জিত, অস্বাভাবিক জমি উন্নয়ন ব্যয়সহ বিভিন্নভাবে সম্পদ বাড়িয়ে দেখানোর মাধ্যমে এই গুরুতর অনিয়ম করা হয়েছে। যে রিপোর্ট বিএসইসির তদন্ত কমিটি জমা দেয়।

বিদ্যমান পাবলিক ইস্যু রুলস অনুযায়ি, বুক বিল্ডিংয়ে পদ্ধতিতে কাট-অফ প্রাইস নির্ধারনে সরাসরি ভূমিকা রাখে কোম্পানির সম্পদ। আর এই সুযোগ কাজে লাগাতেই ভূয়া সম্পত্তি দেখায় এশিয়াটিক কর্তৃপক্ষ। যার মাধ্যমে খুবই অপরিচিত এশিয়াটিক ফার্মা ৫০ টাকার মতো কাট-অফ প্রাইস নির্ধারিত হয়েছে। অথচ এই কোম্পানির নাম এবং ওষুধ বাজারে আছে, তা জানেই না মানুষ।

কোম্পানিটিকে শেয়ারবাজারে আনতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে প্লেসমেন্ট গ্যাংয়ের সদস্য ফরিদ এর নেতৃত্ব। যার সঙ্গে কাজ করে ইউনুসুর রহমান, কাজী সাইফুর রহমানসহ অন্যান্যরা। তারা এশিয়াটিকে অনেক টাকার প্লেসমেন্ট বাণিজ্য করেছে। কিন্তু কোম্পানিটির আইপিও স্থগিত হওয়ায় বিপদে পড়ে। এই অবস্থায় কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে খরচ করে কোম্পানিটিকে শেয়ারবাজারে আসার পথ পরিস্কার করতে কাজ করে।

জানা গেছে, বিএসইসির তদন্ত কমিটি এশিয়াটিকের বিষয়ে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়। যেখানে বিভিন্ন অনিয়মের কথা তুলে ধরা হয়। এর আগে গত বছরের ১৫ জানুয়ারি কোম্পানিটির স্থায়ী সম্পদ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা অনুসন্ধানে কমিশন তদন্ত কমিটি গঠন করে। যা কোম্পানিটির আইপিওতে আবেদন গ্রহনের ঠিক আগের দিন। যা সমাধানের জন্য আবেদন গ্রহণ স্থগিত করা হয়। পরে বিএসইসি জরিমানার আইওয়াশের মাধ্যমে চলতি বছরের ৪-৮ ফেব্রুয়ারি আবারও আইপিওতে আবেদন গ্রহণ করতে দেয়। এর মাধ্যমে বিতর্কিত কোম্পানিটি শেয়ারবাজার থেকে তুলে নেয় ৯৫ কোটি টাকা।

অথচ জাল দলিলের মাধ্যমে সম্পদের মূল্য বেশি দেখিয়ে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের সব আয়োজন সম্পন্ন করেছিল ওষুধ খাতের কোম্পানি এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ। বিএসইসির তদন্তে কোম্পানিটির ভয়াবহ এ জালিয়াতির তথ্য বেরিয়ে আসে। এ অপরাধে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ (এমডি) পাঁচ পরিচালককে ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এর বাইরে জালিয়াতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার দায়ে কোম্পানিটির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) ও কোম্পানি সচিবকে ৫০ লাখ জরিমানা করা হয়। আর এ জালিয়াতি আড়াল করে কোম্পানিটিকে শেয়ারবাজারে আনার উদ্যোগ নেওয়ায় এর ইস্যু ম্যানেজার শাহজালাল ইকুইটি ম্যানেজমেন্টকে ৫০ লাখ জরিমানা করা হয়।

বিএসইসির তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ তাদের আইপিও প্রসপেক্টাস বা বিবরণীতে রাজধানীর তেজগাঁও, টঙ্গীর মাছিমপুর ও গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ৬৬৮ শতাংশ সম্পত্তি দেখিয়েছে। আইপিও প্রসপেক্টাসে এসব সম্পত্তির দাম দেখানো হয়েছে প্রায় ৮৬ কোটি টাকা। আর এসব জমির উন্নয়নে খরচ করা হয় আরও প্রায় ৩৭ কোটি টাকা। কিন্তু বিএসইসির তদন্তে বেরিয়ে আসে, জাল দলিল তৈরি করে এসব জমির বেশির ভাগেরই দাম বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। তাই কোম্পানিটির এ সম্পদমূল্যকে ভুয়া বা অসত্য বলে তদন্ত প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

এশিয়াটিকের আবেদন স্থগিত করে গঠিত তদন্ত কমিটির তদন্ত কার্যক্রমও স্থগিত করে দেওয়ার জন্য জোর তৎপর চালিয়েছিল এশিয়াটিকের প্লেসমন্টে গ্যাং। তবে শিবলী কমিশনের কমিশনার শেখ সামসুদ্দিন আহমেদের কারনে তদন্ত কার্যক্রম স্থগিত করা সম্ভব হয়নি। সেই চক্রটিই শেয়ারবাজারের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে টাকা খরচের মতো অবৈধ উপায়ে আইপিও বাতিল ঠেকায় এবং তালিকাভুক্ত করতে সক্ষম হয়।

এশিয়াটিক ল্যাবের সম্পত্তি নিয়ে প্রতারণার বিষয়টি খুবই গুরুতর ছিল বলে জানিয়েছেন বিএসইসির এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। যা কোনভাবেই কোম্পানিটির আইপিও দেওয়ার জন্য উপযুক্ত নয়। বরং প্রতারণার দায়ে কোম্পানি কর্তৃপক্ষসহ ইস্যু ম্যানেজারের নামে মামলা করা উচিত ছিল। একইসঙ্গে আর্থিক জরিমানা ও শেয়ারবাজারে আজীবন নিষিদ্ধ করা দরকার ছিল। তাহলে অন্যরাও অপকর্ম করা থেকে দূরে সরে আসতো। কিন্তু এমন একটি বিতর্কিত কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আনা হয়।

উল্লেখ্য, এশিয়াটিক ল্যাবের সম্পত্তিসহ বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে বিস্তারিত পরের পর্বগুলোতে তুলে ধরা হবে।

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে