ঢাকা, বুধবার, ৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১

অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে কোটি কোটি টাকার প্লেসমেন্ট শেয়ার

২০২৩ সেপ্টেম্বর ২০ ০৯:১৮:১৩
অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে কোটি কোটি টাকার প্লেসমেন্ট শেয়ার

শেয়ারবাজার থেকে টাকা উত্তোলনের আবেদনের আগে হুট করে অ্যাগ্রো অর্গানিকা ২৭ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানি থেকে ৩৮ কোটি টাকা হয়ে যায়। এই অস্বাভাবিক মূলধন বৃদ্ধি করা হয়েছে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে। এমন কিছু প্রতিষ্ঠানের নামে কোটি কোটি টাকার প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যু দেখানো হয়েছে, যেগুলোর অস্তিত্বই নেই। যাতে ওইসব অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ইস্যু করা শেয়ারের বিপরীতে কোম্পানিতে টাকা আসা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। কারন অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে স্বভাবিকভাবেই কোটি কোটি টাকার প্লেসমেন্ট শেয়ার কেনার সক্ষমতা থাকে না।

অর্থ বাণিজ্যর প্রতিনিধিরা অ্যাগ্রো অর্গানিকা থেকে প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যু করা কিছু কোম্পানির সরেজমিনে খোঁজ নিতে গিয়ে কোন অস্তিত্ব পায়নি।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়ে শেয়ারবাজারে অনেক বড় বড় কারসাজি হয়েছে। এরমধ্যে টাকা না দিয়েও প্লেসমেন্ট শেয়ার বেনামে ইস্যু একটি অন্যতম। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো পণ্য বিক্রি থেকে বা অন্যকোন কারনে কোম্পানিতে ঢুকা অর্থকে ওই প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যুর বিপরীতে দেখিয়ে দেয়। যা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বর্তমান চেয়ারম্যান অ্ধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সময়ই বের হয়েছে। তারপরেও এই অপরাধ কিন্তু থেমে নেই। তাই বিষয়টি অবশ্যই কমিশনের আরও ভালোভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। অন্যথায় টাকা ছাড়া শেয়ার ইস্যু করা কোম্পানির শুধু পরিশোধিত মূলধন বাড়ে এবং ব্যবসা ক্রমানয়ে দূর্বল হয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন......

অ্যাগ্রো অর্গানিকার জালিয়াতি : শাস্তির পরিবর্তে পুরুস্কৃত করল বিএসইসি

এক শীর্ষ মার্চেন্ট ব্যাংকের প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তা (সিইও) অর্থ বাণিজ্যকে বলেন, প্লেসমেন্টধারী কোম্পানির অফিস না থাকা অস্বাভাবিক। হতে পারে দু-একটি কোম্পানির অফিস ঠিকানা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু অফিস থাকবে না এবং কোটি টাকার প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনবে, তা যুক্তিসঙ্গত না। তাহলে বুঝতে হবে ওই প্লেসমেন্ট শেয়ারে ঝামেলা হয়েছে।

অ্যাগ্রো অর্গানিকার খসড়া প্রসপেক্টাসের ২১ পৃষ্টা অনুযায়ি, কোম্পানিটির ২০১৯ সালের ৩০ জুন পরিশোধিত মূলধন ছিল ২৭ লাখ টাকার কম। যে কোম্পানিটির শেয়ারবাজারে আসাকে কেন্দ্র করে পরের অর্থবছরে বেড়ে হয়ে যায় ৩৮ কোটি টাকার বেশি। অর্থাৎ কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের প্রায় পুরোটাই বা ৯৯.৩০ শতাংশ ইস্যু করা হয়েছে ২০১৯-২০ অর্থবছরে।

এই হঠাৎ করে মূলধন বৃদ্ধি নিয়ে বাজার সংশ্লিষ্টদের ন্যায় অর্থ বাণিজ্য কর্তৃপক্ষের কাছেও সন্দেহ জাগে। যার আলোকে এই নিয়ে সরেজমিন শুরু হয় প্লেসমেন্টহোল্ডারদের খোঁজ। কিন্তু প্লেসমেন্টহোল্ডার প্রতিষ্ঠানের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহি পরিচালক ও মূখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম অর্থ বাণিজ্যকে বলেন, কমিশন অভিযোগ খতিয়ে দেখে যদি প্লেসমেন্টহোল্ডারদের অস্বিত্ব না পায় এবং ভূয়া হিসেবে প্রমাণিত হয়, তাহলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে কোম্পানি যদি ভবিষ্যতে তালিকাভুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়, তাহলে ওইসব প্লেসমেন্ট শেয়ার ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডে স্থানান্তর করা হবে।

অ্যাগ্রো অর্গানিকার প্রসপেক্টাসে ৪২ পৃষ্টায় প্রদত্ত শেয়ারহোল্ডারদের তালিকায় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রান্যাচার লিমিটেড, ইনভোটেক লিমিটেড, সিনার্জি ট্রেডিং লিমিটেড ও আর.কে এন্টারপ্রাইজের নাম রয়েছে। যেখানে কোম্পানিগুলোর ঠিকানা ও শেয়ারধারনের পরিমাণও রয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে ৩৩ লাখ ৭২ হাজার ২৫০টি শেয়ার রয়েছে। যেগুলোতে প্রতিটি শেয়ারে ১০ টাকা করে হিসেবে ৩ কোটি ৩৭ লাখ ২২ হাজার ৫০০ টাকা বিনিয়োগ দাঁড়ায়।

ওই কোম্পানিগুলো থেকে বিনিয়োগের সত্যতা জানতে অ্যাগ্রো অর্গানিকার প্রসপেক্টাসে প্রদত্ত ঠিকানায় যায় অর্থ বাণিজ্যির প্রতিনিধিরা। কিন্তু একটি ঠিকানাতেও ৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এমনকি সম্প্রতি আপডেটেড প্রসপেক্টাসে সিনার্জি ট্রেডিং লিমিটেড এর পরিবর্তিত ঠিকানায় গিয়েও কোম্পানিটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অন্যগুলোর ঠিকানা আপডেটেড প্রসপেক্টাসে অপরিবর্তিত রয়েছে।

সম্প্রতি প্রসপেক্টাস আপডেট করার আগে সিনার্জি ট্রেডিং লিমিটেড এর ঠিকানা দেখানো হয়েছিল-

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্লেসমেন্টহোল্ডার গ্রান্যাচার লিমিটেড ও ইনভোটেক লিমিটেড এর ঠিকানা দেখানো হয়েছে অ্যাগ্রো অর্গানিকার অফিস ভবনে। তবে কোন ফ্লোরে প্লেসমেন্টহোল্ডার দুটির ঠিকানা, তা উল্লেখ করেনি। প্রতিবেদক বিস্তারিত জানতে প্রসপেক্টাসে উল্লেখিত ৬৫ এলিফেন্ট রোডের ভবনে ঢুকে সব কয়টি অফিস ফ্লোরে গিয়ে কোন অস্তিত্ব পায়নি। এছাড়া ভবনে দায়িত্বরতরা ওই দুটি কোম্পানির নাম শোনেনি বলে জানায়।

এরপরে ৫ লাখ ২১ হাজার ৬৮৩টি প্লেসমেন্ট শেয়ার ধারন করা গ্রান্যাচার কোম্পানির ওয়েবসাইটে ঢুকে একটি যোগাযোগের নাম্বার পাওয়া যায়। ট্রু কলার অ্যাপসে যার নাম্বার দেখায় কাজী মাহমুদুল বারীর নাম। যার সঙ্গে যোগাযোগ করলে, তিনি জানান কোম্পানিটি বন্ধ আছে। আর ১১ লাখ ৫০ হাজার ৫৬৭টি প্লেসমেন্ট শেয়ারধারন করা ইনভোটেক লিমিটেডের নামে ওয়েবসাইটও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন....

শেয়ারবাজারে আসার আগে ২৭ লাখ টাকার কোম্পানি হয়ে গেল ৩৮ কোটি

এদিকে বিজয় স্মরনীতে লায়ন শপিং কমপ্লেক্সে ২ লাখ প্লেসমেন্ট শেয়ারহোল্ডার হিসেবে আর.কে এন্টারপ্রাইজের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ওই ভবনের ৩য় তলায় অফিস ঠিকানা দেখানো হয়েছে। তবে ভবনটির কোন ফ্লোরেই আর.কে এন্টারপ্রাইজের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এছাড়া ওই ভবনে থাকা কয়েকটি দোকানের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞেস করলেও আর.কে এন্টারপ্রাইজ নামের কোন প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে কিছুই বলতে পারেননি।

অন্যদিকে আপডেটেড প্রসপেক্টাসে ১৫ লাখ প্লেসমেন্ট শেয়ারধারী সিনার্জি ট্রেডিং কোম্পানির ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের ১৫৯/সি। তবে ওই ৫ তলা ভবনের কোন ফ্লোরেই সিনার্জি ট্রেডিং নামের কোন কোম্পানির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এমনকি ভবনের কয়েকজনের কাছে জানতে চাইলে, তারা এমন কোম্পানির নাম শোনেনি বলে জানান।

এরপরে অ্যাগ্রো অর্গানিকার প্রসপেক্টাসে প্রদত্ত্ সিনার্জি ট্রেডিংয়ের পূর্বের ঠিকানা গুলশান-১ এর নিকেতনের ব্লক-ই, রোড-৮ এর ৩৪ ও ৩৬ নম্বর মুন আইল্যান্ড ভবনে গিয়েও কোম্পানিটির বিষয়ে কোন অস্তিত্ব জানা যায়নি। আবাসিক ওই ভবনের দায়িত্বরতরা এই কোম্পানির নামই শোনেননি বলে জানান। যার কোন অফিস কখনো ওই ভবনে ছিল না বলেও তারা জানান।

এছাড়া সিনার্জি ট্রেডিং কোম্পানি নামে গুগলে সার্চ দিয়েও ওই কোম্পানির কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে সিনার্জি ট্রেড কর্পোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট পাওয়া যায়। যেখানে যোগাযোগের প্রদত্ত নামারে কল দিলে অপরসাইড থেকে জানানো হয়, তারা শেয়ার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত না এবং তাদের কোম্পানির নাম সিনার্জি ট্রেডিং লিমিটেড না।

এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন অর্থ বাণিজ্যকে বলেন, ভুয়া ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে প্লেসমেন্টের অভিযোগ পুরাতন। টাকা ছাড়াই যে প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যু করা হয়, তার একটি প্রমাণ সেই প্লেসমেন্টধারীর অস্তিত্ব না থাকা। যে প্রতিষ্ঠান কোটি কোটি টাকার প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনে, তার অস্তিত্ব না থাকাটা অবশ্যই স্বাভাবিক না। কিন্তু এগুলো দেখবে কে? নিয়ন্ত্রক সংস্থা যদি ভালোভাবে খতিয়ে দেখে, তাহলেই অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যুর প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে।

এ বিষয়ে জানতে গত ১৪ সেপ্টেম্বর অ্যাগ্রো অগ্রানিকার ঠিকানায় মেইল করা হয়। এছাড়া হোয়াটসঅ্যাপে কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) মোহাম্মদ শরীফুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু কোম্পানির পক্ষ থেকে কোন মন্তব্য করেনি।

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে